বর্ষার জলরাশি যেন চলনবিলে প্রকৃত জৌলুস ফিরে পায়

বর্ষার জলরাশি যেন চলনবিলে প্রকৃত জৌলুস ফিরে পায়

চাটমোহর সংবাদদাতা : প্রবাদে আছে ‘বিল দেখতে চলন, গ্রাম দেখতে কলম’। ষড়ঋতুর এই দেশে চলনবিল যেন প্রকৃতির এক বহুরূপী ক্যানভাস। ঋতুর পালাবদলে এর চেহারাও বদলায়। বর্ষায় এ বিল হয়ে ওঠে সৈকতের মতো বিশাল জলরাশির আধার, আর সেই রূপেই যেন ফেরে এর প্রকৃত জৌলুস।

বর্ষা মৌসুমে চলনবিল ভরে ওঠে অথই পানিতে। উথালপাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে যায় আকাশের রং। শরতে যোগ হয় অপূর্ব সবুজের সমারোহ, হেমন্তে সোনালি ধানের সুবাসে মেতে ওঠে পুরো অঞ্চল। শীতে হলুদ-সবুজে মোড়া মাঠ আর প্রকৃতির নিস্তব্ধতা, আর গ্রীষ্মে পানির সংকটে রুক্ষ চেহারা চলনবিল যেন এক পরিবর্তনশীল কবিতা।

চলনবিলের মূল আকর্ষণ বর্ষাকালে নৌভ্রমণ। বিশাল জলরাশি আর নানারকম জলজ প্রাণীতে সমৃদ্ধ এই বিল প্রতি বছরই ভ্রমণপিপাসুদের টেনে আনে।

উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই ঐতিহ্যবাহী বিলটি গঠিত হয়েছে প্রায় ১,৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, ৪,২৮৬ হেক্টর আয়তনের ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটারের ২২টি খাল নিয়ে। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে চলনবিলের বহুমাত্রিক সৌন্দর্যে যোগ হয় ভিন্ন মাত্রা।

বর্তমানে এই বিল বিস্তৃত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও উল্লাপাড়া, নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া, বড়াইগ্রাম এবং পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার ৬২টি ইউনিয়ন ও ৮টি পৌরসভাজুড়ে। এক হাজার ৬০০টি গ্রাম নিয়ে গঠিত এ অঞ্চল। লোকসংখ্যা ২০ লাখের বেশি।

চলনবিল শুধু প্রাকৃতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবেও সমৃদ্ধ। এখানে রয়েছে চাটমোহরে জগৎশেঠের কুঠির, বুড়াপীরের দরগা, সিংড়ায় হজরত ঘাসি দেওয়ান (রহ.)-এর ৩৫০ বছরের পুরনো মাজার, ফরিদপুরের বনওয়ারীনগর জমিদারবাড়ি, এবং কিংবদন্তির বেহুলা-সুন্দরীর পিতৃভূমি ‘জিয়ন কূপ’।

নাটোরের গুরুদাসপুরের খুবজিপুর গ্রামে রয়েছে চলনবিল জাদুঘর, যেখানে সংরক্ষিত আছে বিলাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র। এছাড়াও রয়েছে দেশের বৃহত্তম গোবিন্দ মন্দির, কপিলেশ্বর মন্দির, বারুহাসের ইমামবাড়ি, শীতলাইয়ের জমিদারবাড়ি, হান্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দির এবং শাহ জিন্দানীর মাজার।

সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ও প্রমথনাথ বিশীর পৈত্রিক নিবাস এই অঞ্চলেই, যথাক্রমে পাবনার চাটমোহরের হরিপুর ও বড়াইগ্রামের জোয়াড়িতে।

বেহুলা-লখিন্দরের উপকথা এখনো ছড়িয়ে আছে এই জনপদের মানুষের মুখে মুখে। সিরাজগঞ্জের বিনসাড়া গ্রামে রয়েছে বেহুলা-লখিন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাশে রয়েছে বেহুলার কূপ। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, কাছের খাড়ির নিচে আজও লুকিয়ে আছে বেহুলার নৌকা।

নিমগাছি হাটের পশ্চিমে অবস্থিত বিশাল দীঘি ‘জয়সাগর’ নিয়ে প্রচলিত আছে চমকপ্রদ উপকথা যেখানে রাজকুমার ও রাজবধূর সলিল সমাধির কাহিনি এখনো জনমনে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিরাজগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক দীপক কুমার কর বলেন, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চলনবিলকে রক্ষা করতে হবে। তবে, কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এমন হওয়া উচিত নয় যাতে বিলের পরিবেশের ক্ষতি হয়।

প্রবীণ সাংবাদিক এসএম হাবিবুর রহমান বলেন, চলনবিল প্রকৃতির এক দুর্লভ রূপ। বর্ষায় সৈকতের মতো বিশাল জলরাশির বিল পর্যটকদের মন কাড়ে। এখানকার প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন ও উপকথাগুলো বিলাঞ্চলকে ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *