রনি ইমরান,পাবনাঃ
প্রমত্তা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন নিজ জেলায় যাতায়াত করতে হয় পাবনা ও কুষ্টিয়ার ১৬ গ্রামের ৪০ হাজারের বেশি মানুষকে।অদ্ভুত সীমানা জটিলতায় যুগের পর যুগ এসব মানুষের নিদারুণ কষ্টের অন্ত নেই। কখনো নৌকায় ভেসে ,কখনো ৫ কিলোমিটার পদ্মার উত্তপ্ত ধুধু বালুচরে হেঁটে গৌন্তব্যে পৌঁছায় চরাঞ্চলের অবহেলিত মানুষ।এসব অঞ্চলে নেই নুন্যতম চিকিৎসা ব্যবস্থা।নেই পুলিশ ক্যাম্প, পোস্ট অফিস,ব্যাংক, জরুরি সরকারি সেবা।রাস্তা ঘাট অবকাঠামো প্রয়োজনীয় নাগরিক সুবিধা থেকে যুগ যুগ ধরে তারা বঞ্চিত। কাগজ কলমে তারা এক জেলার বাসিন্দা হলেও হাটবাজার, শিক্ষা,চিকিৎসা ও দৈনন্দিন জীবন যাপন সবই অন্য জেলায়।সীমানা ভাগাভাগিতে কুষ্টিয়ার ৯ গ্রাম পদ্মার এপারে পাবনা সদরের সঙ্গে আর পাবনার ৭টি গ্রাম পদ্মার ওপারে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার নিকটে রয়ে গেছে।পাবনার সদর উপজেলার দোগাছি ও ভাড়ারা ইউনিয়নের চরভবানীপুর, খাসচর, কণ্ঠবজরা, ধাবড়াকোল, বলরামপুর গ্রাম পদ্মার ওপারে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর নিকটে অবস্থিত। এসব গ্রামের বাসিন্দারা হাটবাজার চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন জীবন-যাপন কুমারখালী ও কুষ্টিয়া শহরের ওপর নির্ভরশীল শুধু জরুরী জমির কাগজপত্র, থানা কাছারিতে পাবনা শহরে আসতে হয় তাদের। নদী বিচ্ছিন্ন এসব মানুষদের শিলাইদহ ঘাটে এসে খেয়া নৌকা পাড়ি দিয়ে পাবনা শহরে আসতে হয়। বর্ষায় প্রমত্তা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ও শুষ্ক মৌসুমে ৫ কিলোমিটারের বেশি পদ্মার ধুধু উত্তপ্ত বালু চরে হেঁটে তাদের অনেক দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।১৭ আগষ্ট রবিবার পাবনা সদরের কোমরপুর পদ্মা ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপার থেকে আধা ঘন্টা পর পর নৌকায় করে ঘাটে আসছে পাবনার জেলার বাসিন্দারা। কুষ্টিয়া কুমারখালীর কলেজ ছাত্র মো.আবু সালেহীন জানায়, পাসপোর্টের কাজ করতে পাবনা শহরে যাবেন তিনি। বর্ষায়
সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় করে নদী পথ দিয়ে আসতে হয়। এতে অনেক দুর্ভোগের শিকার হোন তারা। পাবনা সদর উপজেলার ভাড়েরা ইউপি সচিব সেলিম উদ্দিন জানান,ভাড়েরা ইউনিয়নের পদ্মা নদীর ওপারে প্রত্যন্ত ৭টি গ্রামের মানুষ নানা প্রতিকূলতায় বসবাস করছে। তাদের ইউপি কার্যালয় বা জেলার কোর্ট-কাছারিতে সেবা নিতে হলে পদ্মা পাড়ি দিয়ে আসতে হচ্ছে।যা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যয়বহুল ও কষ্টদায়ক। এই ভোগান্তিকর সীমানা জটিলতায় পাবনা সদর উপজেলার গা ঘেঁষে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চরসাদিপুর ইউনিয়ন রয়েছে। চরসাদিপুর ইউনিয়ন থেকে পাবনা শহরের দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। অথচ তাদের নিজ জেলা কুষ্টিয়া শহরে যেতে হয় ২৯ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে। ৫ কিলোমিটার নৌকায় করে পদ্মার উত্তপ্ত ধুধু বালুচরে হেঁটে তাদের কুষ্টিয়া যেতে দিনের অর্ধেক সময় ব্যয় হয়। ১৯৯৮ সালে গঠিত প্রায় ২৫ বর্গমাইলের এই ইউনিয়নে আরোয়াবান্ধা, গোবিন্দপুর, সাদিপুর, চরঘোষপুর, চাদেরহাট সহ ৯ গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করে। কুষ্টিয়া জেলার এই ইউনিয়নের বাসিন্দাদের হাট-বাজার, শিক্ষা চিকিৎসা সবই পাবনা শহরের ওপর নির্ভরশীল। চরসাদিপুর ইউনিয়নে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় তৈরি হয়েছে বড় গর্ত।অধিকাংশ রাস্তায় ইট খোয়া বিলীন হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে রাস্তায় হাটু সম ধূলায় চলাচল করে গাড়ি। রাস্তার আশপাশের শত শত মানুষের বাড়ি ঘরের ভেতর বসবাসের অবস্থা হারিয়েছে।গ্রীষ্মে ধূলার কারণে তাদের জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় চরম অবহেলিত চর সাদিপুরের মানুষ। প্রশাসনের নজরদারির অভাবে দিনেদিনে সেখানে বাড়ছে মাদক, বাল্যবিবাহ, চুরি, ডাকাতি সহ নানান অপরাধমূলক কাজ। পাবনা সদরের ঘোষপুরের বাসিন্দা ইজিবর হোসেন বলেন, চরসাদিপুরের বাসিন্দাদের চলাচল, হাট-বাজার, শিক্ষা চিকিৎসা সবই পাবনায়।তারা অসুখ হলে পাবনার হাসপাতালে সেবা নেয়,বাজারে ব্যবসা করে।এই এলাকার শিক্ষার্থীরা পাবনার স্কুল কলেজে পড়ালেখা করে।ইউনিয়নটি পাবনার সাথে সংযুক্ত হলে অবহেলিত জনগোষ্ঠী আলোর মুখ দেখবে।স্থানীয়রা বলেন, এই অবহেলিত ইউনিয়নে পদ্মার দুর্গমচর পাড়ি দিয়ে পুলিশ ও সরকারী অফিসাররা খুব কম আসে। ফ্রি সার বীজ সরকারি সেবা বঞ্চিত তারা। কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। রাস্তা ঘাটের চরম বেহাল দশা। চরসাদিপুর ইউনিয়নের ১ নং ওর্য়াডের বাসিন্দা মোঃ আলতাফ হোসেন বলেন, কুষ্টিয়ার নদী বিচ্ছিন্ন এই ইউনিয়নটি চরম অবহেলিত।চরসাদিপুরের শতকরা ৮০ ভাগের বেশি অবহেলিত মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি ইউনিয়নটি পাবনা জেলার সাথে সংযুক্তির। পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন নিজ জেলা কুষ্টিয়ার কুমারখালীর একটি কলেজে শিক্ষকতা করতে যান আরিফ হোসেন তিনি বলেন, এই ইউনিয়নের শিক্ষার্থীরা পাবনার স্কুল কলেজে পড়ালেখা করছে। এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র নদীর ওপারে হওয়ায় পদ্মা পাড়ি দিয়ে সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে না শিক্ষার্থীরা।পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র রিমন হোসেন বলেন,আমরা চর সাদিপুরে বাসিন্দা কিন্তু পাবনার জেলার ভোটার হয়েছি।এখানকার তরুণরা অনেকেই পাবনার নতুন ভোটার হচ্ছেন বলে জানায় তিনি। বয়সে প্রবীণ শাহেদা আক্তার বলেন, তিনি কুষ্টিয়ার জেলার বাসিন্দা হলেও তিনি ৭০ বছরের জীবনে কখনো নদী পাড়ি দিয়ে কুষ্টিয়া যায়নি। নিজ চোখে কুষ্টিয়া শহরও দেখেনি। পাবনা শহরেই তাদের হাট বাজার।পাবনা শহরই তাদের সুখ দুঃখের শেষ ঠিকানা বলে জানায় তিনি ।প্রমত্তা পদ্মা নদী বিচ্ছিন্ন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অবস্থানের ভিত্তিতে নিকট জেলার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিই হতে পারে এই সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় বলে মনে করেন,পাবনায় পদ্মা নদী বিচ্ছিন্ন অবেহেলিত অধিবাসীরা।